তাহারেই পড়ে মনে (সুফিয়া কামাল)

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - বাংলা - সাহিত্যপাঠ | NCTB BOOK
26.1k
Summary

কবির সঙ্গে এক আলাপে বসন্তের আগমন নিয়ে খুব সুন্দরভাবে আলোচনা হয়েছে। কবি বলেন, বসন্তের গান গাওয়া উচিত, তবে তিনি মনে করছেন কেন সে তা করতে পারছেন না। কবি ফাগুনের সৌন্দর্যের প্রতি বিমুখ এবং অসন্তুষ্ট।

সে প্রশ্ন করে, কি কারণে বসন্তের প্রকৃতি তার প্রতি উদাসীন। মূলত, কবির অন্তরে একটি বিষন্নতা রয়েছে, যা তাকে বসন্তকে স্বাগতম জানাতে বাধা দিচ্ছে। কবির অভিমান এবং প্রিয় ঋতুর প্রতি তার অবসাদ তাদের কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু।

“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়, বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”

কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-

“দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?

বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?

দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম, “কেন কবি আজ

এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”

কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-

“অলখের পাথার বাহিয়া

তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান? ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”

কহিলাম, “ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি, বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি ।”

কহিল সে মৃদু মধু-স্বরে-

“নাই হলো, না হোক এবারে-

আমারে গাহিতে গান, বসন্তেরে আনিতে বরিয়া-

রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তা ফাগুনে স্মরিয়া।”

কহিলাম : “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই? যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।” 

কহিল সে পরম হেলায়- 

"বৃথা কেন? ফাগুন বেলায় 

ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?

মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?” 

“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?” 

কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”

কহিল সে কাছে সরে আসি -

“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-

গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে

রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে ।”

Content added By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

অতীত ও মানবমনের সম্পর্ক
অতীত ও প্রেমের সম্পর্ক
প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্ক
প্রকৃতি ও অতীতের সম্পর্ক
কবি অসুস্থ হওয়ায়
কবি ভাবুক বলে
কবি উন্মনা বলে
কবি অভিমানী হওয়ায়

লেখক-পরিচিতি

1.9k

সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের বিশিষ্ট মহিলা কবি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২০এ জুন বরিশালে । তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায় । কবির পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী এবং মায়ের নাম সাবেরা বেগম । যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলমান নারীদের কাটাতে হতো গৃহবন্দি জীবন । স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিল না। ওই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন । তারই মধ্যে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন । পরবর্তীকালে সাহিত্য সাধনা ও নারী আন্দোলনে ব্রতী হয়ে তিনি শুধু কবি হিসেবেই বরণীয় হননি, জননী সম্ভাষণে ভূষিত হয়েছেন ।

সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে : “সাঁঝের মায়া', 'মায়া কাজল', 'কেয়ার কাঁটা', ‘উদাত্ত পৃথিবী' ইত্যাদি । এছাড়াও তিনি গল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা লিখেছেন । বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি ।

সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০এ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন

Content added By

শব্দার্থ ও টীকা

1.6k

হে কবি - কবিভক্ত এখানে কবিকে সম্বোধন করেছেন ।

নীরব কেন - উদাসীন হয়ে আছেন কেন? কেন কাব্য ও গান রচনায় সক্রিয় হচ্ছেন না। 

ফাল্গুন যে এসেছে ধরায় - পৃথিবীতে ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে।

তব বন্দনায় - তোমার রচিত বন্দনা-গানের সাহায্যে । অর্থাৎ বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে কি  তুমি বরণ করে নেবে না? 

দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? -   কবির জিজ্ঞাসা- বসন্তের দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে কি না। উদাসীন কবি যে তা লক্ষ করেননি তার এই জিজ্ঞাসা থেকে তা স্পষ্ট হয়।

 

বাতাবি নেবুর ফুল…অধীর আকুল  - বসন্তের আগমনে বাতাবি লেবুর ফুল ও আমের মুকুলের গন্ধে দখিনা বাতাস দিগ্বিদিক সুগন্ধে ভরে তোলে। কিন্তু উন্মনা কবি এসব কিছুই লক্ষ করেননি। কবির জিজ্ঞাসা তাঁর উদাসীনতাকেই স্পষ্ট করে।

এখনো দেখনি তুমি? - কবিভক্তের এ কথায় আমরা নিশ্চিত হই প্রকৃতিতে বসন্তের সব লক্ষণ মূর্ত হয়ে উঠেছে। অথচ কবি তা লক্ষ করছেন না ।

কোথা তব নব পুষ্পসাজ - বসন্ত এসেছে অথচ কবি নতুন ফুলে ঘর সাজাননি । নিজেও ফুলের অলংকারে সাজেননি ।

অলখ - অলক্ষ । দৃষ্টি অগোচরে। 

পাথার - সমুদ্র। 

বসন্তেরে আনিতে.... ফাল্গুন স্মরিয়া - কবি বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে বর্ণনা করলেও বসন্ত অপেক্ষা করেনি। ফাল্গুন আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে। 

করিলে বৃথাই -  ব্যর্থ করলে অর্থাৎ কবি-ভক্তের অনুযোগ-বসন্তকে কবি বরণ না করায় বসন্তের আবেদন গুরুত্ব হারিয়েছে 1

পুষ্পারতি - ফুলেল বন্দনা বা নিবেদন ।

পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন? - ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ ও বন্দনা করার জন্য গাছে গাছে ফুল ফোটেনি? অর্থাৎ বসন্তকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই যেন ফুল ফোটে । 

মাধবী - বাসন্তী লতা বা তার ফুল ।

অর্ঘ্য বিরচন - অঞ্জলি বা উপহার রচনা । প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে।

উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা  - কবিভক্ত বুঝতে পারছেন না, কবি যথারীতি সানন্দে বসন্ত বন্দনা না করে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন কেন ।

কুহেলি - কুয়াশা ।

উত্তরী -  চাদর । উত্তরীয় । *

কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী - কবি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসীরূপে কল্পনা করেছেন। যে সন্ন্যাসী কুয়াশার চাদর পরিধান করে আছে ।

পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে - শীত প্রকৃতিতে দেয় রিক্ততার রূপ গাছের পাতা যায় ঝরে । গাছ হয় ফুলহীন । শীতের এ রূপকে বসন্তের বিপরীতে স্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতি বসন্তের আগমনে ফুলের সাজে সাজলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ততার ছবি । শীত যেন সর্বরিক্ত সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাদর গায়ে পত্রপুষ্পহীন দিগন্তের পথে চলে গেছে ।

তাহারেই পড়ে মনে - প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ত ও বিষণ্ণ ছবি । কবির মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। তার কণ্ঠ নীরব। শীতের করুণ বিদায়কে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই বসন্ত তার মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারছে না। বসন্তের সৌন্দর্য তার কাছে অর্থহীন, মনে কোনো আবেদন জানাতে পারছে না প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর প্রথম স্বামী ও কাব্যসাধনার প্রেরণা- পুরুষের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির অন্তরে যে বিষণ্ণতা জাগে তারই সুস্পষ্ট প্রভাব ও ইঙ্গিত এ কবিতায় ফুটে উঠেছে।

Content added By
Content updated By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

অগভীর স্থান
ঘটনাস্থান
কবরস্থান
গভীর খান
অপরিচিত সংস্কৃতি
বিদেশি সংস্কৃতি
নেতিবাচক সংস্কৃতি
প্রতিবেশী সংস্কৃতি
প্রার্থনা
নায়েব
ঐকতান
অন্দরমহল

পাঠ-পরিচিতি

1.9k

“তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় । এ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি পেয়েছে । সাধারণভাবে প্রকৃতির- সৌন্দর্য মানবমনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। বস্তুত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যে কবিমনে আনন্দের শিহরণ জাগাবে এবং তিনি তাকে ভাবে ছন্দে সুরে ফুটিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত কিন্তু কবিমন যদি কোনো কারণে ক শোকাচ্ছন্ন কিংবা বেদনা-ভারাতুর থাকে তবে বসন্ত তার সমস্ত সৌন্দর্য সত্ত্বেও কবির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারবে না।

এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখময় ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে (১৯৩২) কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে । তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণ্ণতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে । “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে এই বিষাদময় রিক্ততার সুর । তাই বসন্ত এলেও উদাসীন কবির অন্তর জুড়ে রিক্ত শীতের করুণ বিদায়ের বেদনা ।

কবিতাটির আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর নাটকীয়তা । গঠনরীতির দিক থেকে এটি সংলাপনির্ভর রচনা কবিতার আবেগময় ভাববস্তুর বেদনাঘন বিষণ্ণতার সুর এবং সুললিত ছন্দ এতই মাধুর্যমণ্ডিত যে তা সহজেই পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায় ।

Content added By
Content updated By
Promotion
NEW SATT AI এখন আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

Are you sure to start over?

Loading...